মাতৃগর্ভ থেকেই অামাদের ব্যক্তিত্ত্ব গঠন শুরু হয়। সে সময় থেকেই অামার অস্তিত্বকে অন্যরা কিভাবে স্বীকার করছে, কতটা চাইছে, কিভাবে তাদের মাঝে অর্থাৎ এই পৃথিবীতে অামাকে স্বাগত জানাচ্ছে এ বিষয়গুলো শুধুমাত্র অামাদের অনুভূতিতে সিগন্যালের মত জমা থাকে। সে সময় যেহেতু তার মধ্যে চিন্তা তৈরী হয় না, তাই এ অনুভূতি কিভাবে তৈরী হল বা এর পেছনে কি চিন্তা কাজ করেছে তার কোন ব্যাখ্যা থাকে না।
বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট এবং ট্রানজ্যাকশনাল অ্যানালাইসিস তত্ত্বের জনক এরিক বার্ণ এর মতে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মের পরে দুই বছর বয়সের মধ্যেই শিশুদের মধ্যে অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় এক ধরনের অনুভূতি তৈরী হয়। এটি তার ও অন্যদের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে নিজস্ব অনুভূতি যা ব্যক্তির মানসিক গঠন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ অামাদের খুব পছন্দের, অনেক ক্ষেত্রেই অামি তার মত হতে চাই। অাবার কাউকে হয়ত ততটা পছন্দ করি না অথবা খুব খারাপ লাগে; তার সামনে যেতে ভয় হয়, রাগ হয়।
অাসলে অামি যে মানুষের ব্যক্তিত্বে অাকৃষ্ট হই, স্বস্তি বোধ করি তার সাথে কথা বলতে, যার পছন্দের সাথে অামার পছন্দ মিলে যায় তার প্রতি অামি অাকৃষ্ট বোধ করি। অামার ব্যক্তিত্বই মূলত ঠিক করে, সিদ্ধান্ত নেয় অামি কার সাথে কেমন অনুভব করব। যার কাছে অামি সম্মানিত বোধ করি, ভালোবাসা পাই তার সাথে মিশতে অাগ্রহ বোধ করি। সবসময় যে অাসলে অপর পক্ষের ব্যক্তিত্ব বা অাচরণের কারনেই অামরা স্বস্তি বোধ করি সবসময় তা নয়। অনেক কিছুই অামি কিভাবে কোন পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করছি, অামার ভাবনায় তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করছি তার উপরেও নির্ভর করে।
অামি ফেসবুকে একজনের একটা শেয়ারিং পড়ছিলাম। তিনি লিখেছেন ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তার কেমন একটা অনুভূতি হয়, উনি যে বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না সে গুলোকে খুব সহজ মনে হয় ওখান থেকে বের হয়ে অাসার পরে। তার খুব অস্বস্তি হয় ভেবে যে উনি ইন্টারভিউ বোর্ডে এই সহজ ও জানা বিষয়ে বলতে পারেন নি।
এমন পরিস্থিতিতে কিন্তু অামরা মাঝে মধ্যেই পরি। মনের অজান্তেই অজানা একটা ভয় কাজ করে যার জন্য জানা বিষয়টিকে উপস্থাপন করতে পারি না। কখনও কখনও ভয়টা এতটা প্রকট হয় যে কোন ছোট বেলায় ছোট কিংবা বড় ঘটনা বা পরিস্থিতিতে অামার গ্রহণযোগ্যতাকে অামি যেভাবে মূল্যায়ন করেছি তার উপর। অামার সে মূল্যায়ন ও তার উপর ভিত্তি করে অামার অনুভূতি অাজও কোন পরিস্থিতি কিংবা ঘটনায় প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।
ছোট বেলায় বড়দের সাথে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশার অভিজ্ঞতা থাকলে বড় হয়েও একই ভাবে চালিয়ে যেতে পারি অাবার ছোটবেলায় যারা বড়দেরকে ভয় পেত, এড়িয়ে চলত তারা বড় হয়েও বড়দের ভয় পান, এড়িয়ে চলেন। তা হতে পারে বাবা মা, শিক্ষক এমনকি অফিসের সিনিয়র সহকর্মী। কাজ করতে গিয়ে যেভাবে প্রতিক্রিয়া চেয়েছিলাম কারও কাছ থেকে তা না পাওয়া বা তিরষ্কার পাওয়ার কারনে এখন হয়ত কোন কাজ করতে গেলেই ঐ অভিজ্ঞতার কথা মনে হয়, অার সাহস হয়না অথবা মনের অজান্তেই সেই অনুভূতি কাজ করে ভেতরে, যা বড় হয়েও অামাদের বিভিন্ন কাজে অাটকে দেয়। এক্ষেত্রে অন্যের অাচরণ নয় বরং দুই বছর বয়সের মধ্যে তৈরী হওয়া অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি ও তার নিজের প্রতি ভিন্ন কাজে অাটকে দেয়।
এভাবেই ছোট বেলার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি অামাদেরকে বর্তমান সময়ে থেকে সময় উপযোগী, যৌক্তিক ও যথাযথ অাচরণ করতে মানসিক ভাবে বাঁধা প্রদান করে। ফলে অামি কোন কাজ করতে গেলে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সচেতন বা অবচেতনভাবে পূর্বঅভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে মিলিয়ে ফেলি এবং তার প্রভাবে অামার বর্তমান সম্ভাবনা, ক্ষমতা ও দক্ষতাকে এড়িয়ে যাই, প্রকৃত ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারি না।
বড় হয়েও শৈশব অভিজ্ঞতার প্রভাবমুক্ত থেকে চিন্তা, মনোভাব প্রকাশ ও অাচরণ করতে না পারা কারণ ই হচ্ছে শৈশব এর অভিজ্ঞতা ও তার প্রেক্ষিতে অামার নিজস্ব ব্যাখ্যা থেকে বয়ে নিয়ে অাসা অনুভূতি। একটা অজানা ভয়, রাগ, কষ্ট বয়ে নিয়ের বেড়াই; নিজের সুপ্ত ক্ষমতাকে উপলব্ধি করে তার বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায় অামার শৈশব অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব ব্যাখ্যা।
তাই সময় উপযোগী, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত অনুভূতি ও অাচরণ করার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে এ ব্যাপারে সচেতনতা, শৈশব এর না পাওয়ার অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেয়া, এর ইতিবাচক গ্রহণযোগ্য ও বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা অন্বেষন করা এবং বর্তমান সময়ের প্রকৃত ক্ষমতাকে উপলব্ধি করা। এ ব্যাপারে সচেতনতাই অামাদের কারও কারও সমস্যাকে দূর করতে পেরে যথাযথ অাচরণের জন্য যথেষ্ট। অাবার কারও সমস্যা একটু গভীরে, তারা নিজেরা এ সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেন না; তাদের জন্য পেশাজীবির সহায়তা প্রয়োজন হয়।
একজন মানুষ তার সমস্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করে সফল ও তৃপ্ত মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে তার জন্য শুধু দরকার হল তথ্য, সচেতনতা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ।